নঈম নিজাম : আরেকটি ভোট হয়ে গেল দেশে। জেলা পরিষদের এ ভোটে রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি অংশ নেয়নি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নিজেরাই লড়েছে। দু-একটিতে ছিল জাতীয় পার্টি। ১০টির বেশি জেলায় জয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহীরা। সে জয়ে ছিল প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা। রাজনৈতিক লড়াই ঘরের ভিতরেও হতে পারে। থাকতে পারে পক্ষ-বিপক্ষ। ঘরের লড়াইয়ে পরকে টেনে আনলেই তৈরি হয় সমস্যা। রূপ নেয় বিশ্বাসঘাতকতায়। নজিরবিহীন এক সুনামি দেখলাম দিনাজপুরে। আওয়ামী লীগ প্রার্থী পেয়েছেন মাত্র ৭৮ ভোট। বিদ্রোহী প্রার্থী ২২৬ ভোট। ভোটে জয়ী জাতীয় পার্টি ১ হাজার ১২৬ ভোট। একটি উপজেলায় আওয়ামী লীগ প্রার্থী পেয়েছেন শূন্য। দিনাজপুরে সব এমপি আওয়ামী লীগের। তার পরও কেন এমন হলো? আমার এক বন্ধু এ নিয়ে প্রশ্ন তুললেন। আমাকে বললেন, ‘১৯৭৫ সালের পর দলের চরম দুরবস্থায়ও এমন ফল কল্পনা করা যায়নি। তাহলে কি পুরো জেলা আওয়ামী লীগ এবং সব এমপি দলীয় প্রার্থী এবং নেত্রীর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেন?’ তাঁর এ প্রশ্নকে উড়িয়ে দিতে পারি না। বিশ্বাসহীনতার এই যুগে দিনাজপুরের ফলাফলে হতাশ হয়েছি। বিস্মিত হইনি। নিজের কান কেটে পরের যাত্রাভঙ্গের রাজনীতি আওয়ামী লীগের পুরনো অভ্যাস। দিনাজপুর দৃষ্টান্তে খারাপ বার্তা গেল সারা দেশে। নেতা-কর্মীদের মধ্যে তৈরি করল অনেক প্রশ্ন। বুঝতে পারছি কেন্দ্রের মনোনীত প্রার্থী কারও পছন্দ হয়নি। তাই বলে কেন্দ্রকে অপছন্দের বার্তা দিয়ে এত কড়া জবাব দিতে হবে? এ কাণ্ডের হোতাদের সঙ্গে একই ঘটনা ঘটলে তারা কীভাবে সামলাবেন? অন্যের ঘরে আগুন দেওয়ার আগে একবার নিজের কথা ভাবুন। রাজনীতিতে ভিন্নমত থাকতে পারে। প্রার্থীও হতে পারে অপছন্দের। তাই বলে কেন ডেকে আনতে হবে অন্য দলকে? কেউ বলছেন, বিজয়ী প্রার্থী দিনাজপুর আওয়ামী লীগের একজন এমপির শ্বশুর। আত্মীয়তার টানে দলের সর্বনাশ! সত্যি সেলুকাস!
মন্ত্রিসভার অনেক সদস্যই মন্ত্রণালয় ও দলীয় নেতৃত্বে অদক্ষ। দলের জাতীয় পর্যায়ের ৮-১০ জন নেতা মাঠে-ময়দানে থাকেন। ২৪ ঘণ্টা দলে সময় দেন। বাকিরা কর্মীদের কাছে নিজেদের তুলে ধরতে পারেননি। দেখাতে পারেননি নিজেদের সাংগঠনিক দক্ষতা। তাদের ব্যর্থতার সুবিধা নিচ্ছেন আমলারা। গত নির্বাচনের পর আমলাদের দেখেছি দলীয় অনুষ্ঠানে অতিথি হতে। কী দরকার? ভালো হোক মন্দ হোক রাজনীতিবিদরা রাজনীতিটা করবেন। তাদের সমর্থনে সরকারের পাশে থাকতে দলে যেতে হয় না। আবার অসহযোগিতা, ষড়যন্ত্রও করতে হয় না। শুধু পালন করতে হয় নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব। সীমারেখায় থেকে রাজনৈতিক সরকারের নীতি-আদর্শ শতভাগ বাস্তবায়ন করলেই চলে। নিজেকে দলবাজ দেখিয়ে আমেরিকান ট্রেজারি ও স্টেট ডিপার্টমেন্টের শতাধিক চিঠির জবাব দূতাবাস না দিলে দলীয় সরকার বিপদে পড়ে। করোনাকালের অজুহাত থোরাই যুক্তি। মহামারিতে আমেরিকা চিঠি দিতে পারলে আমরা কেন জবাব দিতে পারব না? করোনাকালে সবকিছু কি বন্ধ ছিল? দুনিয়ায় মৃত্যু ও জীবন পাশাপাশি হাঁটে। কবরস্থানে প্রিয় মানুষকে রেখে এসেই মানুষ খেতে বসে। আগে মরা বাড়িতে রান্নাবান্না হতো না। পাড়াপড়শিরা খাবার নিয়ে আসত। এখন এত নিয়ম নেই। কবি নাজিম হিকমতের কবিতার মতো শোকও নেই। এখন চলে যাওয়া মানেই শেষ প্রস্থান। তারপর মৃত বাড়ির মানুষ ব্যস্ত হয় সম্পদের ভাগবাটোয়ারা নিয়ে। পরবাসে মারা গেছেন আমার এক আত্মীয়। দুই সন্তান আর স্ত্রীকে রেখে গেছেন। মৃত্যুর পর তার মা-বোন-ভাইয়েরা প্রথমে দখলে নিল রেখে যাওয়া বসতঘর। স্বামীহারা মেয়েটি দেশে এসে দুই সন্তানকে নিয়ে উঠলেন ভাড়া বাসায়। অবুঝ দুই সন্তান পাচ্ছে না বাবার সম্পদ। তাদের বাসা দাদি ও চাচাদের দখলে। মানুষ সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। সুযোগ পেলেই করে সর্বনাশ! আপন-পর বোঝে না। ব্যক্তিজীবন ও রাষ্ট্র আলাদা কিছু না। সুবিধাভোগী অনেক আমলা, বুদ্ধিজীবী এখন চেহারা বদল করছেন। বড় বড় কথা বলছেন। সেদিন একজন প্রশ্ন করলেন, এভাবে আমলাদের বিদায় করা কি ঠিক হচ্ছে? এতে ভুল বার্তা যাবে। আগামী নির্বাচনে পড়বে বিরূপ প্রভাব। জবাবে বললাম, সরকারের নীতি-আদর্শ বিরোধী অবস্থানের কারণে সব সরকারের আমলে চাকরি থেকে বিদায়ের নজির আছে। সবাই নিয়ম মেনেই সব করেছে। এবারও তার ব্যত্যয় হয়নি। ২৫ বছর পর কেউ নিজেও চাকরি ছাড়তে পারেন। আবার সরকারও চাইলে বিদায় দেওয়ার অধিকার রাখে। এখানে ভুল বার্তার কী আছে? রাজনৈতিক সরকার জনগণের কাছে অঙ্গীকার নিয়ে ক্ষমতায় আসে। সেই অঙ্গীকার বাস্তবায়নে সরকারি কর্মকর্তারা বাধা দিলে ব্যবস্থা নিতেই পারে।
দুনিয়ার সব দেশেই সুসময়ে অনেক ধরনের লোক তৈরি হয়। ব্যক্তি, রাষ্ট্র ও সমাজ সবখানে এক চিত্র। নিজেও দেখেছি, যাদের যত বেশি উপকার করেছি তারা তত বেশি ক্ষতি করেছে। সুযোগ পেলেই সুবিধাভোগীরা কৃত্রিম সংকটের উৎসব তৈরি করে। এ গোষ্ঠী শুধু নেয়, তারপর সময়মতো কেটে পড়ে। কোনোভাবেই ওদের খুশি করা যায় না। দুঃসময়ে ওরা থাকে না। খারাপ সময়ে বাতাসের স্রোতে গা ভাসায়। এ নিয়ে হজরত আলীর একটা উপমা আছে। ইসলামের চার খলিফার অন্যতম হজরত আলী (রা.) ছিলেন শক্তিশালী শাসক। বলিষ্ঠতা নিয়ে চলতেন। তিনি হেঁটে গেলে মাটি কেঁপে উঠত। কোনো কিছুর তোয়াক্কা করতেন না। ইসলামের দুঃসময়ে তিনি ছিলেন হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পাশে। তিনি নানা পথপরিক্রমায় বিলম্বে খলিফার দায়িত্ব পেয়েছিলেন। এ নিয়ে ইসলামে দ্বিধাবিভক্তি, অনেক কিছু আছে। সেসব আরেক দিন লিখব। আজ লিখছি ক্ষমতায় থাকাকালে রাষ্ট্রশাসন নিয়ে মিসরের গভর্নর মালিক বিন আশতাবের কাছে লেখা তাঁর চিঠির কথা। সেই চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, ‘মালিক! মনে রাখবেন, মুষ্টিমেয় এই প্রতিপত্তিশালীরা মানবসমাজের আবর্জনা। সমৃদ্ধিকালে, সুদিনে এসব লোকই রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। প্রয়োজনের সময়, বিপদের সময় এরা খুব কমই সহায়ক হয়। রাষ্ট্রের সম্পদ থেকে নেওয়ার বেলায় এদের চাওয়ার শেষ নেই। যতই উদার হোন না কেন, এরা সন্তুষ্ট হবে না। এদের যতই সুযোগ-সুবিধা দেন না কেন, এদের কাছ থেকে কৃতজ্ঞতা আশা করবেন না। ন্যায়সংগত, যুক্তিসংগতভাবে এদের দাবি প্রত্যাখ্যান করা হলেও এরা তা গ্রহণে অনিচ্ছুক এবং সহজে মেনে নেয় না। দিন ও সময় বদলে গেলেও এরা কখনো ধৈর্যশীল হতে পারে না এবং ইমানের ওপর আস্থাশীল থাকে না। অনবরত সমাজের সম্পদের অপচয়ই এদের কাজ।’ হজরত আলীর মতো আক্ষেপ দুনিয়ার অনেক শাসক এভাবে করেছেন। বাস্তবতা অনুধাবনের পরও হজরত আলী (রা)-কে রেহাই দেয়নি ঘাতকের তরবারি। ইসলামের চার খলিফার তিনজনই নিষ্ঠুর খুনের শিকার হন। হজরত আলীর দুই সন্তানও রেহাই পাননি খুনিদের কবল থেকে।
রাজনীতিতে নিষ্ঠুরতা যুগে যুগে ছিল, আছে। আমাদের আজকের প্রধানমন্ত্রী নিজেই ১৫ আগস্ট একটা কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন। ব্রাসেলসে তখনকার রাষ্ট্রদূত সানাউল হকের বাড়িতে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, দুই শিশু জয়, পুতুল ও ড. ওয়াজেদ মিয়া। তাঁরা জার্মানি থেকে ব্রাসেলসে বেড়াতে গিয়েছিলেন। সব ব্যবস্থা করে পাঠিয়েছিলেন জার্মানির রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী। যিনি ১৯৯৬ সরকার আমলে সংসদের স্পিকার হয়েছিলেন। আগের রাতে সানাউল হকের বাড়িতে ছিল অতিথিদের জন্য কান্ডেললাইট ডিনার। সকালে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী ফোনে সানাউল হক ও ওয়াজেদ মিয়াকে ঢাকার বেদনাদায়ক মানব ইতিহাসের নিষ্ঠুর ঘটনা জানান। তখন প্রযুক্তিগত সুবিধা এত ছিল না। টেলিফোন ছিল একমাত্র ভরসা। তা-ও সরাসরি ডায়ালের সুযোগ ছিল না। বঙ্গবন্ধু জীবিত না মৃত তা নিয়ে সংশয় ছিল। তার পরও যতটুকু জানলেন ততটুকু জানিয়েছিলেন হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী। কান্নায় ভেঙে পড়লেন শেখ হাসিনা ও রেহানা। আর এটুকু জেনেই সানাউল হকের চেহারা বদলে গেল। তিনি মুহূর্তের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর জামাতা, নাতি-নাতনি, দুই মেয়েকে বাড়ি থেকে বের করে দেন। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীকে তিনি বলেন, ‘আপনি আমাদের বিপদে ফেলেছেন। এখনই তাদের নিয়ে যান।’ হায়রে মানুষ! হায়রে সভ্যতা! হায়রে কূটনৈতিক শিক্ষা! যাওয়ার সময় গাড়িও দেননি রাষ্ট্রদূত সানাউল হক। একজন জুনিয়র কর্মকর্তার অন্য একটি গাড়ি বঙ্গবন্ধুর উত্তরাধিকারদের এগিয়ে দেয় জার্মান সীমান্ত পর্যন্ত। সেখান থেকে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর গাড়ি বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যাকে এগিয়ে নেয়। আজকের এই প্রেক্ষাপটে অনেক কিছুর হিসাব মেলানো যাবে না। তবে এত কষ্ট ভোগ করেও শেখ হাসিনা কাজ করছেন এ দেশের জন্য। এটাই কঠিন বাস্তবতা। বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর তৈরি। তাঁর মেয়ে সব কষ্ট নীলকণ্ঠে ধারণ করেছেন। এখনো ২৪ ঘণ্টা কাজ করেন অর্থনীতি বদলে ফেলতে। সমৃদ্ধি ধরে রেখে দেশকে স্বাভাবিক রাখতে। এগিয়ে নিতে। পৃথিবীতে এমন দৃষ্টান্ত বিরল।
বারবার একটা কথা বলি, দুনিয়ায় সবচেয়ে সহজ অন্যকে গালাগাল করা। কঠিন হলো নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করা। কিছু মানুষ কাজ করতে করতে জীবন দেয়। আবার কেউ একটা জীবন শেষ করে অন্যের সমালোচনা করে। নিজের দায়িত্ব এড়ায় কৃত্রিম আনন্দে। রক্তক্ষরণ নিয়েও অনেকে পথ চলে আদর্শ বাঁচিয়ে রাখতে। আবার অনেকে অকারণে নিজেদের ভিতরে সমস্যা তৈরি করে। ইডেন কলেজ নিয়ে নোংরা প্রচারণা ছাত্রলীগের ভিতর থেকেই হয়েছিল। কোনো ডকুমেন্ট ছাড়া পদ-পদবির লোভে এক গ্রুপ ভিলেন বানাল আরেক গ্রুপকে। মাঝখানে বারোটা বাজল আওয়ামী লীগের। মাঠের নেতারাও আজকাল সাংবাদিক ডেকে, সামাজিক মাধ্যমে কথা বলছেন একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে। পদ-পদবিতে থেকে কীসের ক্ষোভ বুঝি না। ক্ষোভ যখন দেখাচ্ছেন তখন দলের পদ-পদবিতে থাকবেন কেন? ক্ষমতাবানদের অনেকের কাছে সবকিছু রঙিন লাগছে। মনে রাখবেন, ক্ষমতা হারালে সব হয়ে যাবে সাদাকালো। অনেক মন্ত্রী-এমপি এলাকায় যান না। কর্মীদের সঙ্গে ন্যূনতম সম্পর্কটুকু রাখেন না। মনে করেন ভোটের বাক্সে কাউকে দরকার নেই। প্রভাবশালীরা নিজের অঞ্চলে দল, স্থানীয় সরকারে নিজের পুত্র, কন্যা, স্ত্রী, ভাইবোনকে বসান। এতে বঞ্চিত হন মাঠের ত্যাগী কর্মীরা। তাদের মাঝে ক্ষোভ তৈরি হয়। এ ক্ষোভ বাড়তে থাকে। সেই ক্ষোভেও নেতাদের হুঁশ হয় না। দরকার দল ও সরকারে একটা ছোট্ট শুদ্ধি অভিযান। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে এ অভিযান শেষ করতে হবে। তারপর সবাইকে মন বসাতে হবে ভোটে। একটা নিরপেক্ষ ভোট হবেই ধরে নিয়ে সামনে যেতে হবে। থাকতে হবে ঐক্যবদ্ধ অবস্থানে সেই ভোটে জিতে আসার জন্য। তা না হলে কঠিন খেসারত দিতে হবে। এ বাস্তবতা এড়ানোর সুযোগ নেই।
লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন । সূএ:বাংলাদেশ প্রতিদিন